যুগে যুগে ভূত

Monday, November 26, 2012

ভূতের অস্তিত্ব ছিল সেই আদিকাল থেকেই। ভূত-প্রেত সম্পর্কে মানুষের ধারণা দিন দিন বিবর্তিত হয়েছে মাত্র। আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত ভূতের অস্তিত্বের ধারণা এতটুকু পাল্টে যায়নি। এর প্রমাণ পাওয়া যায় বিশ্বের প্রাচীন উপকথা আর সাহিত্যের দিকে তাকালেই। অনেক ধর্মেই প্রেতাত্দা বা মৃত মানুষের পুনরুজ্জীবনের কথা উল্লেখ আছে। হাজার বছরের পুরনো সমৃদ্ধ দেশ মিসরের কথাই ধরা যাক। মিসরের সংস্কৃতিতে ভূতের প্রকট উপস্থিতি বিশেষভাবে চোখে পড়বে। আজ থেকে প্রায় ছয় হাজার বছর আগে সে দেশে মৃত্যুর পর আত্দার উপস্থিতি তারা বিশ্বাস করত মনেপ্রাণে। তাদের বিশ্বাস অনুসারে সেই আত্দা ছিল প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী। চাইলেই সেই প্রয়াত আত্দা মানব সমাজের উপকার বা ক্ষতি করতে পারত। মিসরের জনজীবনে সেই কারণেই সভ্যতার প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে এ ভূত নামক অশরীরী বস্তু নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে তারা বিশ্বাস করত দীর্ঘকাল। সে দেশের মৃতদের সম্পর্কে নানা রচনাতে আমরা যে তথ্য পাই, তা প্রমাণ করে যে মিসরীয় সভ্যতার প্রাচীনকাল থেকেই তারা ভূতে বিশ্বাসী ছিল। আধুনিককালেও পিরামিডের রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে বেশকিছু রোমাঞ্চকর, রহস্যময় ঘটনা ও কাহিনী চলচ্চিত্রের অবয়বে আমাদের সামনে এসেছে।

হিব্রু টোরাহ অথবা বাইবেলেও বেশকিছু ভূতের উল্লেখ রয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখ্য হলো, স্যামুয়েলের প্রথম গ্রন্থ, যেখানে এনডরের প্রেতাত্দা রাজা সাউলকে বলছে স্যামুয়েল এখন মৃত, এবং সব ইসরায়েল তার শোকে অভিভূত হয়ে তাকে সমাধিস্থ করেছে রাম হতে। এনডারের প্রেতাত্দা প্রমাণ করে ভূতের উপস্থিতি। সেই আমলের চচার্চেল ধর্মযাজকেরাও ভূতের ব্যাখ্যা দিয়ে প্রবচন করতেন এবং মানুষের অব্যাহতির পথ বাতলাতেন।

প্রাচীন গ্রিস বা রোমে ভূতের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। গ্রিক পণ্ডিত কবি হোমরের ইলিয়ডি ও ওডিসিতে এসব অলৌকিক স্পিরিট বা আত্দার বর্ণনা রয়েছে, 'বাষ্প বা ধোঁয়ার মতো' একটি বস্তু হিসেবেও তাদের সঙ্গে পার্থিব মানুষের খুব বেশি দেওয়া-নেওয়া ছিল না। তবে মাঝেমাধ্যেই তারা ভবিষ্যদ্বাণী করত অন্তরীক্ষ থেকে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে এসব রূপদী ভূত হয়ে উঠল ভয়ঙ্কর, ক্ষতিকর ও আতঙ্ক ছড়ানোর বিষয়। দুনিয়ার খারাপ কাজ করতে সিদ্ধহস্ত। কবরস্থানে ডেরা বাঁধল তারা। গ্রিকরা বাৎসরিক উৎসব চালু করত ভূতদের নিয়ে। সেখানে নিজেদের স্বজনকেও আমন্ত্রণ জানানোর প্রথা ছিল। এই সময়েই একটি নাটক অরেস্টিয়া তে প্রথম ভূতের আগমন ঘটে যা সাহিত্যে প্রথম বলে বলা হয়। তবে ভূতের বিষয়ে যে মানুষটি সর্বপ্রথম অবিশ্বাস ব্যক্ত করেন সামোস্টার লুসিয়ান। খ্রিস্টের দ্বিতীয় শতকে। তার কাহিনী 'দ্য ডাউটা'র-এ তিনি লিখেছেন কীভাবে ডেমোক্রিটাস নামের আবডেরা শহরের একজন জ্ঞানী জনপদের বাইরের এক নির্ঝর্ন কারখানায় তিন-তিনবার একাধিক দিন বসবাস করে প্রমাণ করেছেন যে, সমাধিস্থলে আদৌ কোনো ভূত-প্রেত থাকে না। আবার পঞ্চম শতকে লিওন শহরের খ্রিস্টান ধর্মযাজক কনস্টানিটিয়াস বললেন, অশাস্রতঈর পদ্ধতিতে সৎকারের ফলে কবরস্থ মৃত মানুষের আত্দা জীবিতদের কীভাবে উত্ত্যক্ত বিরক্ত করে। মধ্যযুগের ইউরোপের ভূতেরা অনেক বস্তুবাদী। তারা রীতিমতো মানুষের মতো দেয়ালের মধ্য দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেত। কিছু কিছু ভূত ছিল জলীয়-বায়বীয়। ধর্মযাজকদের হস্তক্ষেপে এবং পুজো পাঠে এসব বিপত্তির নিষ্পত্তি হতো। আসি আরব দেশের কথা। আরব্য গল্প-উপন্যাসে ভূতের বা জিনদের ছড়াছড়ি। তাদের নিয়ে লেখা আরবজনির অসংখ্য কাহিনী আমাদের আজও আনন্দ দেয়। ছেলে থেকে বুড়ো সবাই পড়তে ভালোবাসেন, এসব গল্প। খ্রিস্টীয় নবম শতকের এ বিখ্যাত আরবজনি বা আরিবার কাহিনী আজও জনপ্রিয়।

শুধু আরব নয় এশিয়ার পূর্বাংশের চীন, জাপান, মালয় কম্বোজ, ফিলিপাইনস , সুমাত্রা জাভা থেকে শুরু করে নানা ছোট-বড় দেশেও এ ভূতদের অবাধ রাজত্ব চলেছে স্মরণাতীতকাল থেকে। হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম বা তাও কোনো ধর্মেই বাদ নেই ভূত প্রষঙ্গ। কালক্রমে এসব ভূত এসে জায়গা করে নিয়েছে প্রতিটি দেশের সাহিত্য, নাটক বা চলচ্চিত্রে। এমনকি কনফুসিয়াসের মতো দার্শনিক নিজেও বলছেন, ভূতদের শ্রদ্ধা কর ঈশ্বরকে মান্য কর কিন্তু তাদের থেকে দূরে থাকে।

মজার ব্যাপার হলো, পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক চিন্তা ও বিজ্ঞানের দেশ আমেরিকাতেও মানুষ ভূত বিশ্বাস করে। একটি পরিসংখ্যান বলছে সে দেশের শতকরা বত্রিশভাগ মানুষ ভূত প্রেতে বিশ্বাস করে। ২০০৫ সালের গ্যাল্প পোলের তথ্য। বিশ্বাস যে করে, তার প্রমাণ তো আমেরিকার হলিউডে নির্মিত অসংখ্য ডাকুলা ও ঘোস্ট নির্ভর কাহিনী।

ভূতের অস্তিত্ব

পশ্চিমা বিশ্বাস অনুসারে ভূতের অস্তিত্ব রয়েছে। আর কোথায় কোথায় ভূতের অস্তিত্ব থাকে এ নিয়ে তারা গবেষণাও করেছেন। সেই গবেষণা অনুসারে ভূতের অস্তিত্ব জানতে হলে যা খেয়াল করতে হবে তা হলো_

১. ঠাণ্ডা জায়গা। আশপাশের জায়গা থেকে যদি কোনো জায়গা ঠাণ্ডা হয়ে থাকে তাহলে বুঝতে হবে এখানে ভূত আছে বা খানিক আগে ছিল।



২. বৈদ্যুতিক জিনিসপত্রের অদ্ভুত আচরণ। ভূতদের উপস্থিতিতে বৈদ্যুতিক জিনিসপত্র নানা রকম অদ্ভুত আচরণ করে। যেমন_ বাতি জ্বলে-নেভে, রেডিও অন-অফ হয়, টিভি ঝিরঝির করে।




৩. কোনো কিছুর অকারণ নড়াচড়া।


এমনকি কোনো জড়বস্তুও অকারণে নড়াচড়া শুরু করে দেয়। যেমন_ দরজা-জানালা খোলে, আবার বন্ধ হয়।



৪. চোখের সামনে থেকে কোনো কিছু হারিয়ে যায় বা নড়াচড়া শুরু করে।




৫. পানি ক্রমাগত ওপরে ওঠে আবার নিচে নামে।




৬. শীতল কিছুর স্পর্শ অনুভব করা।




৭. নানা ধরনের ভৌতিক শব্দ শোনা। যেমন_ কারও হাঁটার শব্দ, গান, কথা বলার শব্দ, ফিসফিসানি, খটখট শব্দ, বিকট শব্দ, কোনো কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ, টেলিফোন রিং।




৮. কোনো জায়গায় হঠাৎ কোনো আলোর ঝলকানি।




৯. কোনো ছায়া বা কোনো কিছু নড়াচড়া করছে দেখতে পাওয়া।




১০. কোনো প্রাণীর অদ্ভুত আচরণ করা। কারণ ভূতদের অস্তিত্ব প্রাণীরাই প্রথমে টের পায়।

ভূত আসলে কী?

প্রচলিত অর্থে ভূত মানে আত্দা বা অপচ্ছায়া। এর অস্তিত্ব শতভাগ প্রমাণিত না হলেও বিশ্বজুড়ে যুগের পর যুগ মানুষ ভূতে বিশ্বাস করে আসছে। সেই বিশ্বাস অনুসারে ভূত হলো মৃত ব্যক্তির আত্দা যা জীবিত ব্যক্তিদের সামনে দৃশ্যমান বা অন্য কোনো অলৌকিক উপায়ে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে সক্ষম। পৃথিবীর অনেক প্রাচীন লোককাহিনী ও লোকগাথায় যেমন ভূতের অস্তিত্ব রয়েছে, ঠিক তেমনি আধুনিক বিশ্বের মানুষের মুখেও প্রায়ই ভূতের গল্প শোনা যায়। এসব গল্পে ভূতকে নানাভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ বর্ণনায় কখনো অদৃশ্য, কখনো অস্বচ্ছ বায়বীয় কখনো কখনো অদ্ভুতুড়ে প্রাণী আবার কখনো বাস্তবসম্মত সপ্রাণ মানুষ বা জীবের আকারে ভূতকে তুলে ধরা হয়েছে। পৃথিবীর অনেক জাতিই ভূতে বিশ্বাস করে। তাদের মতে, প্রাণীর শরীর থেকে আত্দা চলে গেলেই সে প্রাণহীন হয়ে যায়। কোনো কোনো আত্দা প্রাণীর শরীর থেকে বের হওয়ার পরও ফিরে আসে। আর এই ফিরে আসা আত্দাই হচ্ছে ভূত। কোনো শরীরী রূপ তার থাকে না। সে থাকে অস্পষ্ট। কিন্তু তার চালচলন স্বাভাবিক জীবিত শরীরের মতো। তাকে স্পষ্ট দেখা যায় না। তবে উপলব্ধি করা যায়।

প্রাক-শিক্ষিত সংস্কৃতিগুলোর সর্বপ্রাণবাদ ও পূর্বপুরুষ পূজার মধ্যে ভূতের প্রথম বিবরণ পাওয়া যায়। সেই যুগে কিছু নির্দিষ্ট ধর্মীয় প্রথা, অন্ত্যেষ্টি সংস্কার, জাদু ও ভূত তাড়ানো অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো মৃতের আত্দাকে তুষ্ট করার জন্য। প্রচলিত বর্ণনা অনুযায়ী, ভূত একা থাকে, তারা নির্দিষ্ট কিছু স্থানে ঘুরে বেড়ায়, জীবদ্দশায় যেসব বস্তু বা ব্যক্তির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল সেগুলোকে তাড়া করে ফেরে। তবে ভূতবাহিনী, ভৌতিক ট্রেন, ভৌতিক জাহাজ এমনকি ভৌতিক জীবজন্তুর কথাও শোনা যায়।

বৈজ্ঞানিক যুক্তি

ভূতে বিশ্বাস আছে কি না_ এ রকম প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়নি পৃথিবীতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। পৃথিবীর অনেক দেশেই জরিপ করা হয়েছে সে দেশের মানুষ বা শিশুরা ভূতে বিশ্বাস করে কি না? আর সেই জরিপে দেখা গেছে, অশিক্ষিত ও পিছিয়ে পড়া মানুষ তো বটেই, শিক্ষিত ও সচেতন মানুষও চরমভাবে ভূতে বিশ্বাসী। ২০০৫ সালে আমেরিকার গ্যালপ অর্গানাইজেশন আমেরিকানদের ওপর একটি জরিপ চালায়। জরিপে দেখা যায়, শতকরা ৫২ ভাগ আমেরিকান ভূতে বিশ্বাস করে। ছোটরা তো বটেই, বড়রাও ভূতে বিশ্বাস করে। ভূতের ওপর বিশ্বাস নিয়ে বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা রয়েছে। সে অনুসারে মানুষ সাধারণত অবাস্তব কাহিনীর জন্ম দেয় তার কল্পনাশক্তির ওপর ভর করে। ভূতেরা জন্মের আদিলগ্ন থেকেই আছে; কিন্তু বিজ্ঞানের কাছে এর ব্যাখ্যা নেই। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিকারিরা ভূত শিকার করে চলেছেন। তারা ছবি, ভিডিও এবং ভূতের কথা বলে বেড়াচ্ছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ভুয়া ভূত শিকারিরা একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষকে বোকা বানাচ্ছেন। তাই ভূতের অস্তিত্ব মানেই ভুয়া কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা বিজ্ঞানের লোক তারা অবিশ্বাসের সঙ্গে সব যুক্তি নাকচ করেন। বৈজ্ঞানিক যুক্তি অনুসারে শক্তি বিভিন্নভাবে থাকতে পারে। যেমন_ তাপ, আলো, রাসায়নিক ও বৈদ্যুতিক শক্তি। শক্তি যে কোনো পরিবর্তন আনতে পারে। থার্মোডিনামিঙ্ েআলোচনার বিষয় এই শক্তি। আর শক্তির বিষয়ে থার্মোডিনামিঙ্রে দুটি বিখ্যাত সূত্র রয়েছে। সেই সূত্র যদি বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করা যায় তাহলে প্রমাণ করা সম্ভব ভূত আছে। যদি এটিকে প্রমাণ হিসেবে ধরে নেওয়া যায়, তার পরও মনে কিছু প্রশ্ন থেকেই যাবে। এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করলেই কিছু না কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে। থার্মোডিনামিঙ্রে প্রথম সূত্র থেকে জানি শক্তির কোনো বিনাশ নেই, শুধু এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় যায়। তাহলে, আমরা যদি শক্তি হই তবে মৃত্যুর সঙ্গে আমরা বিনাশ হব না, শুধু রূপ পরিবর্তন হবে। আমাদের শরীর বিশ্লিষ্ট হয় মাইক্রো-অর্গানিজম দ্বারা এবং এভাবে মানুষের শক্তির রূপ পরিবর্তিত হয়। এখানে প্রশ্ন থেকে যায়, তাহলে আমাদের বুদ্ধিমত্তার কী হয়? কেননা আমরা আমাদের বুদ্ধিমত্তার বদৌলতেই একটি পরিচয় বহন করি। আমাদের মন কি হাওয়ায় উড়ে যায়? নাকি শুধুই জীবাণুর খাদ্য? এই পরিবর্তন কি মেনে নেওয়া যায়? বিজ্ঞানের চোখ কি বলবে, আমাদের বাইরেও অনেক প্রাণ আছে?

রাজপ্রাসাদে.. ভূত

বাড়ি কিংবা রাস্তা নয়, ভূতের দেখা মেলে রাজপ্রাসাদেও। হ্যাম্পটন ফোর্ট প্রাসাদে দেখা দেন রাজা অষ্টম হেনরি, তার ছয়জন স্ত্রীকে নিয়ে। এদের মধ্যে অ্যান বোলিন ও জেন সিমুরকে হত্যা করা হয়েছিল শিরশ্ছেদের মাধ্যমে। মুণ্ডহীন অবস্থাতেই ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় তাদের ছায়াশরীর। তবে ভূতের সংখ্যায় সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে টাওয়ার অব লন্ডন। অ্যান বোলিনের আত্দা নাকি উদয় হয় এখানেও। সেই সঙ্গে দেখা মেলে টমাস বেকেট, স্যার ওয়াল্টার র্যালে, লেডি জেন গ্রে'র ভূতের। সলিসবারির অষ্টম কাউন্টসের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল এখানেই। সেই ঘটনা রাতে এখনো দেখা যায় এখানে। একটি ভল্লুককেও নাকি দেখা গেছে টাওয়ারের সিঁড়ি দিয়ে নামতে। রাতের পাহারাদার সেই ভল্লুককে বন্দুকের বেয়নেট দিয়ে আঘাত করলে, তার ছায়াশরীর ভেদ করে যায় বেয়নেট এবং সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে যায় সেই ভল্লুকও। উইনচেস্টার ম্যানশনের বদ্ধ রান্নাঘর থেকে আজও নাকি ভেসে আসে খাবারের গন্ধ, বদ্ধ রুমের ভেতরে বসে কেউ যেন অর্গান বাজায়। পাওয়া যায় মানুষের হেঁটে চলে বেড়ানো আর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ।

সাদা বাড়ির কালো ভূত

ওয়াশিংটন ডিসির ১৬০০ পেনসিলভেনিয়া এভিনিউর 'হোয়াইট হাউস' শীর্ষক বাড়িটি কেবল আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্টের বাসভবনই নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক ভবনও বটে। এমন একটি ভবনে যখন ভূত-প্রেতরা আস্তানা গাড়ে তাহলে কেমন হয়? বিশ্বমোড়ল আমেরিকা যখন আধুনিকতার মোড়কে ডিজিটাল বিশ্ব গড়ার নেতৃত্ব দিচ্ছে তখন তাদের প্রেসিডেন্টের বাসভবনে ঘুরে বেড়াচ্ছে ডজনখানেক প্রেতাত্দা! এমন বিশ্বাস কেবল ভৌতিক গল্পপ্রিয় সাধারণ আমেরিকানদেরই নয়, হোয়াইট হাউসের একাধিক সাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারীও নিজেদের এসব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বলে দাবি করেন। হোয়াইট হাউসের পুব দিকের একটি কক্ষে প্রায়ই কাজে ব্যস্ত থাকেন হোয়াইট হাউসের প্রথম ফার্স্ট লেডি এবিগেইল অ্যাডামসের ভূত। আবার মরার পরও বাগানে কাজ করে যাচ্ছেন হোয়াইট হাউসের কর্মচারী ডলি ম্যাডিসন। শুধু তারাই নন, আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আবরাহাম লিঙ্কন, রুজভেল্ট, হ্যারিসন, রিগ্যান, অ্যান্ড্রু জ্যাকসনসহ আরও অনেকের প্রেতাত্দা এখনো দিব্যি ঘুরে বেড়ায় হোয়াইট হাউসে।

হোয়াইট হাউসের প্রাক্তন কর্মচারীদের অনেকেই বলেছেন, বাড়িটি সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং এখানকার সাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রেতাত্দা দিয়ে ভরা। সাবেক প্রেসিডেন্ট হ্যারিসনের আত্দাটি বিভিন্ন সময় চিলেকোঠার জিনিসপত্র তছনছ করে কী যেন খুঁজত। প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসনের ভূতকে প্রায়ই তার শয়নকক্ষে দেখা যেত। আবার ফার্স্ট লেডি এবিগেইল অ্যাডামসকে প্রায়ই হলওয়েতে ভাসতে দেখা যেত।

হোয়াইট হাউসে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় প্রেসিডেন্ট আবরাহাম লিঙ্কনের ভূতকে। মিসেস ম্যারি টড লিঙ্কন স্বামীর প্রেসিডেন্সির সময়ই পুত্র উইলিকে হারান। হোয়াইট হাউসের গ্রিন রুমে বসে মৃত পুত্রের সঙ্গে প্ল্যানচেটের মাধ্যমে মাঝেমধ্যে যোগাযোগের চেষ্টা করতেন। স্বামীর গুপ্তহত্যার পরও তিনি একই চেষ্টা করেছেন। পরবর্তীকালে তিনি বোস্টনের এক ভাস্কর 'মামলার'-এর স্টুডিওতে গিয়েছিলেন। কথিত আছে, এ মামলার মৃত ব্যক্তিদের অশরীরী অস্তিত্বের ছবি পাথরে খোদাই করতে পারত। ম্যারি মামলারকে দিয়ে এমন একটি ছবি খোদাই করিয়েছিলেন। এখানে ছাপা হওয়া ছবিতে ম্যারির কাঁধে যে আবছা হাতের অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে সেটি আবরাহাম লিঙ্কনের প্রেতাত্দার। হোয়াইট হাউসের ভূত কাহিনীতে একটি বিষয় লক্ষণীয়, তা হচ্ছে এখানকার কোনো ভূতই আশ্চর্যজনকভাবে কারও কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করেনি। ভূতপ্রিয় আমেরিকানদের কাছে এগুলো বিশ্বাসযোগ্য কিংবদন্তিতুল্য ভৌতিক ঘটনা হলেও অনেকের কাছেই এগুলো গালগল্প ছাড়া আর কিছুই নয়। 

দ্যা মোর হাউস

দ্যমোর হাউস নামে পরিচিত এই বাড়িতে ১৯১২ সালে একসঙ্গে আটজনকে খুন করা হয়। খুন করার পদ্ধতিটাও ছিল ভয়ানক। প্রত্যেকের মাথায় একটি করে কুঠার ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। নিহতদের মধ্যে ছিলেন জসিয়াহ বি মোর, তার স্ত্রী সারা, তাদের সন্তান হারমান, ক্যাথরিন, ভয়েড এবং পল। আরও ছিলেন তাদের বাসায় বেড়াতে আসা দুজন মেহমান। এর পর থেকে এ বাড়িতে নানা রকম প্যারানরমাল ব্যাপার ঘটার নোটিস পাওয়া গেছে। বেশির ভাগ মানুষের কথা অনুযায়ী ভুতুড়ে ব্যাপারগুলো হলো :

বাড়িটি থেকে রাতের বেলা বাচ্চাদের আওয়াজ পাওয়া যায়। কারা যেন রাতের বেলা বাড়িজুড়ে দৌড়ে বেড়ায়। বাড়ির ভেতর থেকে গভীর রাতে ট্রেন যাওয়ার মতো আওয়াজ পাওয়া যায়। যদিও বাড়িটি রেললাইন থেকে বহু দূরে। ধারণা করা হয়, খুনি যখন সেই আটজনকে মেরেছিল তখন তাদের মরণ চিৎকার ঢাকার জন্য খুনি কোনোভাবে ট্রেনের শব্দ তৈরি করেছিল। সে সময় মি. মোরের সন্তানেরা ছোট ছিল, তাই হয়তো বাড়িতে পাওয়া যাওয়া সেই বাচ্চাদের দৌড়ানোর আওয়াজ তাদের পায়ের হতে পারে। অতৃপ্ত আত্দা, যা আটকা পড়ে আছে

এখনো সেই বাড়িতে। খুনি কে ছিল সে সম্পর্কে আজ পর্যন্ত কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। 

উইন্ডসর ক্যাসেলে রানী এলিজাবেথ

বিখ্যাত উইন্ডসর ক্যাসেলে নাকি এখনো ঘুরে বেড়ান প্রথম এলিজাবেথ। প্রথম হাইহিল জুতার আওয়াজ পাওয়া যায়। তার পরই দেখা যায় তাকে। রয়্যাল লাইব্রেরির পাশ দিয়ে হেঁটে ভেতরের ঘরে ঢুকে যান। ওখানে যারা গেছেন, তাদের সবারই নাকি এ রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে।

র‌্যালেখিন হাউস

স্কটল্যান্ডের র্যালেখিন হাউসের ভূতের কীর্তিকলাপ ছিল সাংঘাতিক। কিন্তু সব জেনেশুনেই টমাস হেডেন দুই ছেলে টম আর রবিন ও তার স্ত্রীকে নিয়ে বাড়িটা কিনে থাকতে শুরু করলেন। প্রথম রাত থেকেই শুরু হলো প্রেতাত্দার উৎপাত। প্রচণ্ড গরম ছিল সেদিন। মাঝরাতে কোথা থেকে হঠাৎ শৈত্যপ্রবাহ শুরু হলো। শোনা গেল কারা যেন কথা বলছে, সিঁড়িতে পায়ের শব্দ, দুমদাম আওয়াজ। ভয়ে রবিন অজ্ঞান হয়ে গেল। এর পর ঢংঢং করে ঘণ্টা বাজতে শুরু করল। পর মুহূর্তে দরজায় জোরে জোরে ধাক্কার শব্দ। দরজা-জানালা নিজে নিজে খুলে যাচ্ছে। সারা বাড়িতে কাদের যেন শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শোনা যেতে লাগল। একসময় ভয়ে বাড়ির সবাই অজ্ঞান হয় গেলেন। পর দিন সাইকিক সোসাইটর সদস্যরা পুলিশ নিয়ে সারা রাত কাটালেন ওই বাড়িতে। 

অদ্ভুতুড়ে

ভারতের রাজস্থানের বেনগার দুর্গকে রীতিমতো সরকারিভাবে ভুতুড়ে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। পৌরাণিক মতাদর্শানুযায়ী, রানী রত্নাবালী এবং রাজা সিংশ্রিয়ার মধ্যে এক তুমুল তান্ত্রিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল এখানে এবং

রাজা সে যুদ্ধে পরাজয় বহনপূর্বক মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তিনি মৃত্যুর আগে অভিশাপ দিয়ে যান, যে ব্যক্তি সূর্যোদয় হওয়ার আগে এবং সূর্যাস্ত যাওয়ার পড়ে এখানে অবস্থান করবে তার মৃত্যু হবে। সম্প্রতি আর্কিওলোজিক্যাল

সার্ভে অব ইন্ডিয়া স্থানটিকে 'হন্টেড' বা ভুতুড়ে ঘোষণা করেছে।

প্যারিসের ক্যাটাকম্ব জাদুঘরটি মূল শহরের মাটির নিচে একটি টানেল আকারে গড়ে তোলা। প্রায় ৬০ লাখ মানব কঙ্কাল দিয়ে এটি গড়ে তোলা হয়েছে। শোনা যায়, মৃতদের আত্দা নাকি এই টানেলে প্রায়ই দৃশ্যমান হয়।


থাইল্যান্ডে একটা ১৮ তলা এপার্টমেন্ট আছে। এ এপার্টমেন্টে থাকা বেশির ভাগ মানুষ হলো বিভিন্ন দেশ থেকে থাইল্যান্ডে পড়তে আসা স্টুডেন্ট। এই এপার্টমেন্টে এ পর্যন্ত ৬টি আত্দহত্যার ঘটনা ঘটেছে। যারা আত্দহত্যা করেছেন তারা সবাই স্টুডেন্ট আর এর মাঝে সবাই এপার্টমেন্ট থেকে লাফ দিয়ে আত্দহত্যা করেছেন। এই এপার্টমেন্টে কয়েকটা ফ্ল্যাট আছে যেগুলোর রুমে প্রায় ২৪ ঘণ্টাই ফিসফিস করে কথা বলার আওয়াজ শুনতে পায় সেই ফ্ল্যাটে বসবাসকারী স্টুডেন্টরা।

অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে খ্রিস্টানদের একটা পুরনো কবরস্থান আছে। সেটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কেউ বেখেয়ালে ভেতরে তাকালে শুধু একটি নির্দিষ্ট কবরফলক দেখতে পায়। সেই কবরটা হলো এমা ফ্লরেন্স নামক এক মহিলার। আজব ব্যাপার হলো, দ্বিতীয় বার কেউ যখন ভালো করে সেই কবরস্থানের ভেতরে তাকায় তখন সে হাজার খুঁজেও সেই এমা ফ্লরেন্সের কবরটি দেখতে পায় না। এই ব্যাপারটি মেলবোর্নের বহুলোকের বেলায় ঘটেছে।


দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন থেকে ১৬৪১ সালে ক্যাপ্টেন হেনড্রিক ভ্যান ডার ডেকেন তার জাহাজ নিয়ে বের হন। তার ইচ্ছা ছিল সমগ্র বিশ্বভ্রমণ করে আবারও তার প্রিয় দেশে প্রত্যাবর্তন করা। কিন্তু তার জাহাজ আর কোনো দিন ফেরেনি, ভয়াল সমুদ্র হয়তো তা গ্রাস করেছে। আজও নাকি গভীর সমুদ্রে একটি নাবিক শূন্য ভুতুড়ে জাহাজের দেখা মেলে। লোকে এর নাম দিয়েছে দ্য ফ্লাইং ডাচম্যান।


যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপ্টেন রিন্ডসে হাউস মূলত এন্টিক সংগ্রহশালা। অনেকেই বলেন, এখানে নাকি পরমাত্দারা প্রায়ই বিচরণ করে। প্রচলিত গল্পগুলোর মধ্যে একটি হলো_ হঠাৎ পাশের ঘরে একটি শব্দ হলো, দর্শক পাশের ঘরে গিয়ে দেখল যে, সবকিছুই যথাযথ স্থানে সাজানো আছে। অতঃপর তারা আগের ঘরে ফিরে এসে দেখল বিছানার চাদরে পাঁচ আঙ্গুলের হাতের ছাপ!


ম্যাসাচুসেটসের ৪৪ নম্বর রুটের লাল চুলো আগন্তুক এক কুখ্যাত ভূত। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মতে, চলমান গাড়ি থেকে রাস্তার মাঝখানে হন্টনরত একটি লোককে নাকি প্রায়ই দেখা যায়। পরনে জিন্সের প্যান্ট, লাল ফ্লানেলের শার্ট, দাড়ি এবং চুল লাল রঙের এই ভদ্রলোক নাকি এই রাস্তাতেই অনেক দিন আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন।

 

 ভয়াবহ বাড়ি

 ১৭০৪ সালের জানুয়ারির এক সকাল। মি. ওয়ানিকুর ও তার পরিবার পাশের মাঠে কাজ করছিলেন। তখন ভেনেজুয়েলাজুড়ে দাঙ্গা চলছিল। ওয়ানিকুরের বাড়িতে হামলা চালায় একদল দাঙ্গাকারী। ঘরের সব মালামাল লুটপাট করে। মাঠের মধ্যে খুন করে ওয়ানিকুরের স্ত্রীকে। এর পর বাপের চোখের সামনে ১৪ জন পুরুষ মিলে ধর্ষণ করে একমাত্র মেয়েটিকে। সইতে না পেরে ওয়ানিকুর দড়ির বাঁধন ছিঁড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন শত্রুর ওপর। এই ফাঁকে তার দুই যমজ ছেলেকে গুলি করে মারে দাঙ্গাকারীরা। ওয়ানিকুরকে অজ্ঞান করে ফাঁসি দেওয়া হয়। পরে এই বাড়িটিতে বাস করতে আসে এক গরিব দম্পতি এবং তাদের পাঁচ বছরের একটি শিশু মেয়ে। বাড়িতে ঢোকার দিন থেকেই তারা লক্ষ্য করতে থাকেন, রাত নামলেই বাড়িটিতে কাদের যেন উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। প্রায়ই ঘরের টিনের চালে রাতের বেলা ধস্তাধস্তির আওয়াজ হয়। তার পরও সেই পরিবার বাড়িটি ছেড়ে যায়নি। পরিণাম হয় খুব ভয়াবহ। বাড়ির পাশে একদিন তাদের বাচ্চা মেয়েটাকে পাওয়া যায়। শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন। পাশেই পড়ে আছে একটি মেয়ের ছবি। ছবির সেই মেয়েটি ওয়ানিকুরের ১৪ বছরের মেয়েটি, যাকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছিল তাদের বাড়ির সামনেই। 

রণক ইকরাম

ভূত, আছে নাকি নাই?

'ভূত', নাম শুনতেই শরীরের ভেতর কেমন যেন একটা গা ছমছমে ভাব চলে আসে। ভয়ের কারণ, তবু আগ্রহের কোনো কমতি নেই। পৃথিবীতে এমন একটা মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবে না যে ছোটবেলায় ভূতের গল্প শোনেনি। আর বড়বেলায় এসেও ভূত-প্রেত বিষয়ে মানুষের আগ্রহ এতটুকু কমে না। অনেকের অবিশ্বাস থাকলেও ভূত সবারই আগ্রহের কারণ। 

মানুষ সব সময়ই রহস্যপ্রিয়। অতিপ্রাকৃত বা ব্যাখ্যার অতীত বিচিত্র সব বিষয় নিয়ে মানুষের বেশি আগ্রহ। আর রহস্যময় পৃথিবীতেও এরকম বিচিত্র বিষয় আর ঘটনার কোনো শেষ নেই। তবে পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত, সৃষ্টির আদি থেকে আজকের আধুনিক সময় পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি চর্চিত বিষয় হচ্ছে ভূত। এ অদৃশ্য অলৌকিক এবং কাল্পনিক অবয়বটির প্রতি একটা বয়সে অনুসন্ধিৎসা থাকে প্রবল। বিষয়টি হয়তো ওই অর্থে বিজ্ঞাননির্ভর নয়। তবুও মানুষের মন থেকে অলৌকিক বিষয় একেবারে মুছে দেওয়া সহজ কাজ নয় মোটেই। বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিরা ভূত-প্রেত বা এরকম অলৌকিক বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালালেও বিশ্বজুড়ে ভূতের অস্তিত্ব মেনে নিতে অনেকেই এখনো দ্বিধাহীন। সবচেয়ে বড় বিষয়, যে কোনো কারণেই হোক মানুষ ভূত নামক সেই অদৃশ্য অলৌকিক বস্তুটির প্রতি মানসিকভাবে দুর্বল। ভূত বলতে আসলে কিছু আছে কি? এ নামের কোনো সত্তা পৃথিবীতে বিরাজ করে কি-না এ নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কোনো শেষ নেই। এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নিয়েও রয়েছে ঢের বিতর্ক। শাস্ত্র মতে, ভূত বা প্রেতাত্দা যাই বলা হোক না কেন এসব আধ্যাত্দিক জিনিসের অস্তিত্ব পৃথিবীতে আছে। অধিকাংশ বিশ্বাস অনুসারে তারা মানুষের মতো না হয়েও মানুষের সঙ্গেই এই পৃথিবীতে বাস করে। একই বিশ্বাস অনুসারে তাদের জগৎ-বিশ্বাস-ধ্যান-ধারণা সবকিছুই মানুষের চেয়ে আলাদা।

পৃথিবীর নানা প্রান্তের উপকথা, গল্প এবং জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে ভূতের উল্লেখ। বলা হয়েছে, ভূত হল আত্দা বা স্পিরিট। একজন মানুষের মৃত্যুর পর তার অদৃশ্য উপস্থিতি। যদিও তার বিবরণ সর্বত্র এক নয়। কোথাও বায়বীয়, কোথাও জলের মতো, কোথাও ছায়া আবার কোথাও তারা পশু-পাখির অবয়বে বিরাজমান। পৃথিবীর সব ধর্মেই ভূতের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়েছে। ইংরেজিতে ঘোস্ট শব্দটির প্রাচীন ইংরেজির গাস্ট থেকে উদ্ধৃত। ল্যাটিনে 'স্পিরিটাস' শব্দটির অর্থ হলো শ্বাস বা জোরে বাতাস ত্যাগ করা। এমন নানা ব্যাখ্যা রয়েছে। বিভিন্ন ভাষায়, সেই আদিকাল থেকেই মানুষ সভ্য হওয়ার পরে, মোটামুটি যখন জ্ঞানের আলো একটু একটু করে প্রবেশ করেছে তাদের সমাজে, তখন থেকেই ভূত রাজত্ব শুরু করেছে। এর বিশেষ প্রমাণ রয়েছে আফ্রিকা ও বিশ্বের আদিম জাতির সমাজব্যবস্থায়ও আফ্রিকায় তো বটেই, ভারতের আদিবাসীদের মধ্যে ভূতের পূজো হয়ে থাকে। তারা মনে করে, তাদের পূর্বজরা এ রূপেই তাদের কাছে বেঁচে রয়েছে। হিন্দু ধর্মের 'গরুড় পুরাণ' পড়লে দেখা যায় সেখানে ভূতের অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা রযেছে। আমাদের হিন্দু শাস্ত্রে যে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়ে থাকে, তা যে মূর্তের আত্দার সঙ্গতির উদ্দেশ্যে সে কথা বিশদ করে বলার প্রয়োজন নেই। সেখানে বিভিন্ন মন্ত্রে 'ভূত' এবং 'প্রেত' শব্দ দুটির বহুবার উল্লেখ রয়েছে। পণ্ডিতেরা এই ভূত বা প্রেত বলতে বলেছেন, ভূত শব্দটি এসেছে ভূ তা বা অতীত শব্দ থেকে। প্রেত এসেছে প্রয়াত শব্দ থেকে।

একটা কথা তো মানতেই হবে যে ভূত থাক বা না থাক, তাকে নিয়ে মানুষের জিজ্ঞাসা ও কৌতূহলের অন্ত নেই। যেমনটা ঘটেছে সৃষ্টিকর্তা নিয়ে। যুক্তিবাদীরা স্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়েও কম কথা বলেন না। তবুও কিন্তু মানুষ স্রষ্টায় বিশ্বাস করে। আবার বিজ্ঞানের অনেক যুক্তি সংজ্ঞা অনুসারেও কিন্তু স্রষ্টার অস্তিত্বের ব্যাপারটি প্রমাণিত। সব মিলিয়ে দেখা যায় যে, মানুষের জীবনের সঙ্গে অলৌকিকত্বের একটা সম্পর্ক কোনো না কোনোভাবে থেকেই যাচ্ছে। আর বিজ্ঞান সব অলৌকিকত্ব বা বিষয়কে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে শতভাগ সাফল্য দেখাতে পারেনি। তাই অলৌকিক বা সুপার ন্যাচারাল একটা চিন্তা বা ধারণা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। আর সে কারণেই ভূত বিষয়ে মানুষের এমন বিশ্বাস। আর বিজ্ঞান যদি মানুষকে সফলভাবে এসব ব্যাখ্যা দিতে পারত তাহলে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বিশ্বের সিংহভাগ মানুষ এসবে বিশ্বাস রাখত না মোটেই।

ভূতের অস্তিত্বের প্রমাণ কাগজে-কলমে দেওয়া হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু বিশ্বসাহিত্যের দিকে তাকালে দেখা যায় এর অনেকটা জুড়েই রয়েছে ভূত। এক্ষেত্রে ভূত সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করল, নাকি সাহিত্য ভূতের অস্তিত্ব স্বীকার করল, এ প্রশ্ন বহু পুরনো। সেই প্রাচীন সাহিত্যে সংস্কৃতি গ্রিক, রোমান, ল্যাটিন, হিবরু, চিনা, আরবি ইত্যাদি। লেখা হয়েছে ভূতবিষয়ক হাজার হাজার রচনা। আবার অনেক রচনায় অত্যাবশ্যকভাবে এসেছে ভূত। পরবর্তীকালে, মধ্যযুগে বা তারও পরে, যখন সাহিত্য রোমান্টিসিজমের পুনরুত্থান ঘটল তখন [ষোড়শ শতকের গোড়া থেকে ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত], তাতেও নানাভাবে এই ভূত, প্রেত, অপদেবতা বা ডাইনিদের প্রসঙ্গ এসেছে। প্রায় পাঁচশ বছর আগে থেকেই এর সূচনা। শেকসপিয়রের বিভিন্ন নাটকে প্রেতাত্দার অস্তিত্ব কম-বেশি সবারই জানা। এর মধ্যে হ্যামলেট, ম্যাকবেথ, টেমপেস্ট মিউসামার নাইটস ড্রিম তো বহুল চর্চিত নাটক। এসব গল্পের কোথাও অশরীরী ভবিষ্যৎ বক্তা, কোথাও প্রতিশোধ নেওয়া ভূত, কোথাও ধোঁয়ার মতো এরিয়েল আবার কোথাও অন্যকোনো অবয়বে এসব ভূত বা অলৌকিক অশরীরী বিরাজমান রয়েছে।

আমাদের ভারতেও ভূতের ওপর রচিত সাহিত্যের অভাব নেই। সেই বিক্রমাদিত্য জমানার 'বিক্রম বেতাল'- এর কাহিনী থেকে শুরু করে হাল আমলের শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অসংখ্য ভূতের গল্প আজও পাঠকের প্রিয় সঙ্গী। ভারতের বিভিন্ন ভাষায় বহু রোমহর্ষক ভূতের গল্প আমাদের দেশের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করছে। এমনকি হলিউড-বলিউডের বহু বঙ্ অফিস সফল ছায়াছবি ভূতের গল্প নিয়ে রচিত। সব মিলিয়ে ভূতের অস্তিত্ব কিন্তু আমরাই কোনো না কোনোভাবে জানান দিই। 

বাংলাদেশ প্রতিদিন

ভূত-পেত্নী

Saturday, December 26, 2009

ভূত-পেত্নী পরিচিতি

ভূত হলো অশরীরি পুরুষ আত্মা, আর পেত্নী (মহিলা ভুত) অশরীরি মেয়ে আত্মা। অপঘাত, আত্মহত্যা প্রভৃতি কারণে মৃত্যুর পর মানুষের অতৃপ্ত আত্মা ভূত-পেত্নী হয়ে পৃথিবীতে বিচরণ করতে পারে।
ভূত কোথায় থাকে:
শেওড়া, তাল, দেবদারু, বেল, অশ্বত্থ প্রভৃতি গাছে একটি দুটি ভূতের দেখা পেতে পারেন। কিন্তু বেশি সংখ্যায় ভূত দর্শনের অভিলাষ থাকলে, আপনাকে যেতে হবে বিজন বনে, তেপান্তরে, কিংবা ভূষণ্ডির মাঠে।
ভূতের গল্পের বর্ণনা মাধ্যম:
ভূতের গল্প উত্তম পুরুষে, অর্থাৎ নিজের জবানিতে বলাই ভালো, তাতে গল্পে অনুভূতির ব্যঞ্জনা তীব্র হয় এবং গা ছমছম ভাবটা প্রকট করা যায়। ভূতের গল্পে স্বভাবতই কাউকে না কাউকে ভূতের পাল্লায় পড়তে হবে, সেটি বর্ণনাকারী নিজেই হতে পারেন।

ভূতের গল্প একটানে বলতে নেই, কিছুটা ভয়ের জায়গায় এসে গল্প থামিয়ে দিয়ে সময় ক্ষেপণ করতে হবে, যাতে অন্যরা অনুরোধ করে গল্প চালিয়ে যেতে। যেমন বলা যায়, "বিজন জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ এক জায়গায় দেখলাম কী..! আচ্ছা, আজ থাক, ঘুম পাচ্ছে, বাকিটা আরেক দিন বলব।"
কিন্তু গল্পের যে অংশগুলি বেশি ভয়ের, বিশেষ করে চূড়ান্ত অংশ, সেখানে না থেমে খুব দ্রুত, জোরে জোরে হঠাৎ বলে ফেলতে হবে। যেমন: "...একথা শুনে লোকটা বলল, আচ্ছা, দেখেন তো এরকম কিনা [নরম স্বরে বলতে হবে] ঘুরতেই দেখি, লোকটার পায়ের কাপড় একটু উপরে, পায়ের পাতা উল্টানো [একটু জোরে], পায়ের আঙ্গুলে কোনো ফাঁক নেই [আরো জোরে], একদম হাঁসের পায়ের মত দেখতে [আরো জোরে বলতে হবে এবং এই দেখো, বলে হঠাৎ গল্পকার নিজের পা দেখিয়ে দেবেন]
ভূতের গল্প বলার উপযুক্ত সময়:
কেউ অনুরোধ করলেই সাথে সাথে ভূতের গল্প বলতে বসে যাবেন না যেন। সব কিছুরই একটা তরিকা আছে। ভূতের গল্প বলতে হয় মজলিসে, আর গল্পের উপযুক্ত সময় হচ্ছে রাতের বেলা, বিশেষ করে বাদল ধারার রাতে। ঝমঝম বৃষ্টির ফোঁটা পড়বে টিনের চালে বা ছাদে, জানালা থাকবে হাট করে খোলা, হালকা বৃষ্টির ছাঁট আসবে ঘরে। তীব্র কোনো আলো রাখা চলবে না, কেবল একটু দূরে হারিকেন, কুপি বা মোমের মৃদু আলো মিটমিট করে জ্বলতে পারে।
প্রেম-ভালবাসায় ভূত-পেত্নী:
ভূত-পেত্নীর শারীরিক সৌন্দর্যের ব্যাপারে নানা মত চালু থাকলেও, প্রেম-ভালবাসায় তাদের নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততা বেশ সুবিদিত। তাই যুগ যুগ ধরে মানব প্রেমিক প্রেমিকা গভীর ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে পরস্পরকে পেত্নী, ভূত নামে আখ্যায়িত করে থাকে।

ভূত-পেত্নী দশার অবসান:
ভূত-পেত্নী অতৃপ্ত আত্মা, পৃথিবীর মায়ায় ইত:স্তত ছুটে বেড়ায়। তাদের জীবন ক্লান্তিকর ভারবহ উদ্দেশ্যহীন, তাই কেউ ভূত-পেত্নীর আত্মা মুক্ত করলে তারা খুশি হয়। আত্মা মুক্ত করার একটি কার্যকর উপায় হলো গয়ায় গিয়ে ভূতের নামে পিণ্ডি দেয়া।

ক্লাইকোপ্স

তিনজন শতভুজ দৈত্যের পর ইউরেনাসের ঔরসে গেইয়ার গর্ভে তিনজন ক্লাইকোপ্স [গ্রিক ভাষায় ক্যুকল্পস্] জন্ম নেয়। তারাও তাদের অগ্রজ শতভুজ দৈত্যের মতো দানবাকৃতির ছিল। তাদের কপালের মাঝখানে শুধু একটি চোখ ছিল। হেসিয়দের থিওগনি অনুযায়ী তাদের নাম হলো_ ব্রন্তেস [বজ্র], স্তেরোপেস [বজ্র] ও আর্জেস [তীব্র আলোকচ্ছটা] হেসিয়দের থিওগনি অনুযায়ী তারা প্রত্যেকেই ছিল বলিষ্ঠ, বিশালদেহী ও একরোখা। করত কামারের কাজ তারা। তাদের পিতা ইউরেনাস সন্তানদের অদম্য শক্তি দেখে ভয় পেয়ে যান এবং তাদেরও শতভুজ দৈত্যদের মতো তার্তারাস কারাগারে বন্দি করে রাখে। পরে ইউরেনাস পুত্র ক্রোনাস তাদেরকে শতভুজ দৈত্যদের সঙ্গে তার্তারাস কারাগার থেকে মুক্ত করে। কিন্তু পিতা ইউরেনাসকে সিংহাসনচ্যুত করার পরই আবার তাদের বন্দি করা হয়। একই পন্থায় ক্ষমতার দখল নেন ক্রোনাসের পুত্র জিউস। তিনিও ক্লাইকোপ্স ও শতভুজ দৈত্যকে কারাগার থেকে মুক্ত করে পিতা ক্রোনাসকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। জিউসের প্রধান অস্ত্র বজ্র ক্লাইকোপ্সরাই তৈরি করে দেয়। আর্জেস এতে আনে উজ্জ্বলতা আর ব্রন্তেস দেয় শক্তি। স্তেরোপেস একে দেয় তীব্র আলোকচ্ছটা। সমুদ্রদেবতা পোসাইডনের ত্রিশূল, চন্দ্রদেবী আর্টিমিসের ধনুক ও চাঁদের আলোর তীর, সূর্যদেবতা অ্যাপোলোর ধনুক ও সূর্যরশ্মির তীর, পাতালদেবতা হেডিসের শিরস্ত্রাণও ক্লাইকোপ্সরা নির্মাণ করে। পরবর্তীকালে সূর্যদেবতা অ্যাপোলোর হাতে ক্লাইকোপ্সরা নিহত হয়। জিউস অ্যাপোলোর পুত্র অ্যাস্কিপিয়াসকে বজ্রাঘাতে বধ করায় অ্যাপোলো প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ক্লাইকোপ্সদের তীর নিক্ষেপ করে হত্যা করে।