যুগে যুগে ভূত

Monday, November 26, 2012

ভূতের অস্তিত্ব ছিল সেই আদিকাল থেকেই। ভূত-প্রেত সম্পর্কে মানুষের ধারণা দিন দিন বিবর্তিত হয়েছে মাত্র। আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত ভূতের অস্তিত্বের ধারণা এতটুকু পাল্টে যায়নি। এর প্রমাণ পাওয়া যায় বিশ্বের প্রাচীন উপকথা আর সাহিত্যের দিকে তাকালেই। অনেক ধর্মেই প্রেতাত্দা বা মৃত মানুষের পুনরুজ্জীবনের কথা উল্লেখ আছে। হাজার বছরের পুরনো সমৃদ্ধ দেশ মিসরের কথাই ধরা যাক। মিসরের সংস্কৃতিতে ভূতের প্রকট উপস্থিতি বিশেষভাবে চোখে পড়বে। আজ থেকে প্রায় ছয় হাজার বছর আগে সে দেশে মৃত্যুর পর আত্দার উপস্থিতি তারা বিশ্বাস করত মনেপ্রাণে। তাদের বিশ্বাস অনুসারে সেই আত্দা ছিল প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী। চাইলেই সেই প্রয়াত আত্দা মানব সমাজের উপকার বা ক্ষতি করতে পারত। মিসরের জনজীবনে সেই কারণেই সভ্যতার প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে এ ভূত নামক অশরীরী বস্তু নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে তারা বিশ্বাস করত দীর্ঘকাল। সে দেশের মৃতদের সম্পর্কে নানা রচনাতে আমরা যে তথ্য পাই, তা প্রমাণ করে যে মিসরীয় সভ্যতার প্রাচীনকাল থেকেই তারা ভূতে বিশ্বাসী ছিল। আধুনিককালেও পিরামিডের রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে বেশকিছু রোমাঞ্চকর, রহস্যময় ঘটনা ও কাহিনী চলচ্চিত্রের অবয়বে আমাদের সামনে এসেছে।

হিব্রু টোরাহ অথবা বাইবেলেও বেশকিছু ভূতের উল্লেখ রয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখ্য হলো, স্যামুয়েলের প্রথম গ্রন্থ, যেখানে এনডরের প্রেতাত্দা রাজা সাউলকে বলছে স্যামুয়েল এখন মৃত, এবং সব ইসরায়েল তার শোকে অভিভূত হয়ে তাকে সমাধিস্থ করেছে রাম হতে। এনডারের প্রেতাত্দা প্রমাণ করে ভূতের উপস্থিতি। সেই আমলের চচার্চেল ধর্মযাজকেরাও ভূতের ব্যাখ্যা দিয়ে প্রবচন করতেন এবং মানুষের অব্যাহতির পথ বাতলাতেন।

প্রাচীন গ্রিস বা রোমে ভূতের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। গ্রিক পণ্ডিত কবি হোমরের ইলিয়ডি ও ওডিসিতে এসব অলৌকিক স্পিরিট বা আত্দার বর্ণনা রয়েছে, 'বাষ্প বা ধোঁয়ার মতো' একটি বস্তু হিসেবেও তাদের সঙ্গে পার্থিব মানুষের খুব বেশি দেওয়া-নেওয়া ছিল না। তবে মাঝেমাধ্যেই তারা ভবিষ্যদ্বাণী করত অন্তরীক্ষ থেকে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে এসব রূপদী ভূত হয়ে উঠল ভয়ঙ্কর, ক্ষতিকর ও আতঙ্ক ছড়ানোর বিষয়। দুনিয়ার খারাপ কাজ করতে সিদ্ধহস্ত। কবরস্থানে ডেরা বাঁধল তারা। গ্রিকরা বাৎসরিক উৎসব চালু করত ভূতদের নিয়ে। সেখানে নিজেদের স্বজনকেও আমন্ত্রণ জানানোর প্রথা ছিল। এই সময়েই একটি নাটক অরেস্টিয়া তে প্রথম ভূতের আগমন ঘটে যা সাহিত্যে প্রথম বলে বলা হয়। তবে ভূতের বিষয়ে যে মানুষটি সর্বপ্রথম অবিশ্বাস ব্যক্ত করেন সামোস্টার লুসিয়ান। খ্রিস্টের দ্বিতীয় শতকে। তার কাহিনী 'দ্য ডাউটা'র-এ তিনি লিখেছেন কীভাবে ডেমোক্রিটাস নামের আবডেরা শহরের একজন জ্ঞানী জনপদের বাইরের এক নির্ঝর্ন কারখানায় তিন-তিনবার একাধিক দিন বসবাস করে প্রমাণ করেছেন যে, সমাধিস্থলে আদৌ কোনো ভূত-প্রেত থাকে না। আবার পঞ্চম শতকে লিওন শহরের খ্রিস্টান ধর্মযাজক কনস্টানিটিয়াস বললেন, অশাস্রতঈর পদ্ধতিতে সৎকারের ফলে কবরস্থ মৃত মানুষের আত্দা জীবিতদের কীভাবে উত্ত্যক্ত বিরক্ত করে। মধ্যযুগের ইউরোপের ভূতেরা অনেক বস্তুবাদী। তারা রীতিমতো মানুষের মতো দেয়ালের মধ্য দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেত। কিছু কিছু ভূত ছিল জলীয়-বায়বীয়। ধর্মযাজকদের হস্তক্ষেপে এবং পুজো পাঠে এসব বিপত্তির নিষ্পত্তি হতো। আসি আরব দেশের কথা। আরব্য গল্প-উপন্যাসে ভূতের বা জিনদের ছড়াছড়ি। তাদের নিয়ে লেখা আরবজনির অসংখ্য কাহিনী আমাদের আজও আনন্দ দেয়। ছেলে থেকে বুড়ো সবাই পড়তে ভালোবাসেন, এসব গল্প। খ্রিস্টীয় নবম শতকের এ বিখ্যাত আরবজনি বা আরিবার কাহিনী আজও জনপ্রিয়।

শুধু আরব নয় এশিয়ার পূর্বাংশের চীন, জাপান, মালয় কম্বোজ, ফিলিপাইনস , সুমাত্রা জাভা থেকে শুরু করে নানা ছোট-বড় দেশেও এ ভূতদের অবাধ রাজত্ব চলেছে স্মরণাতীতকাল থেকে। হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম বা তাও কোনো ধর্মেই বাদ নেই ভূত প্রষঙ্গ। কালক্রমে এসব ভূত এসে জায়গা করে নিয়েছে প্রতিটি দেশের সাহিত্য, নাটক বা চলচ্চিত্রে। এমনকি কনফুসিয়াসের মতো দার্শনিক নিজেও বলছেন, ভূতদের শ্রদ্ধা কর ঈশ্বরকে মান্য কর কিন্তু তাদের থেকে দূরে থাকে।

মজার ব্যাপার হলো, পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক চিন্তা ও বিজ্ঞানের দেশ আমেরিকাতেও মানুষ ভূত বিশ্বাস করে। একটি পরিসংখ্যান বলছে সে দেশের শতকরা বত্রিশভাগ মানুষ ভূত প্রেতে বিশ্বাস করে। ২০০৫ সালের গ্যাল্প পোলের তথ্য। বিশ্বাস যে করে, তার প্রমাণ তো আমেরিকার হলিউডে নির্মিত অসংখ্য ডাকুলা ও ঘোস্ট নির্ভর কাহিনী।

0 comments: