ভূত, আছে নাকি নাই?

Monday, November 26, 2012

'ভূত', নাম শুনতেই শরীরের ভেতর কেমন যেন একটা গা ছমছমে ভাব চলে আসে। ভয়ের কারণ, তবু আগ্রহের কোনো কমতি নেই। পৃথিবীতে এমন একটা মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবে না যে ছোটবেলায় ভূতের গল্প শোনেনি। আর বড়বেলায় এসেও ভূত-প্রেত বিষয়ে মানুষের আগ্রহ এতটুকু কমে না। অনেকের অবিশ্বাস থাকলেও ভূত সবারই আগ্রহের কারণ। 

মানুষ সব সময়ই রহস্যপ্রিয়। অতিপ্রাকৃত বা ব্যাখ্যার অতীত বিচিত্র সব বিষয় নিয়ে মানুষের বেশি আগ্রহ। আর রহস্যময় পৃথিবীতেও এরকম বিচিত্র বিষয় আর ঘটনার কোনো শেষ নেই। তবে পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত, সৃষ্টির আদি থেকে আজকের আধুনিক সময় পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি চর্চিত বিষয় হচ্ছে ভূত। এ অদৃশ্য অলৌকিক এবং কাল্পনিক অবয়বটির প্রতি একটা বয়সে অনুসন্ধিৎসা থাকে প্রবল। বিষয়টি হয়তো ওই অর্থে বিজ্ঞাননির্ভর নয়। তবুও মানুষের মন থেকে অলৌকিক বিষয় একেবারে মুছে দেওয়া সহজ কাজ নয় মোটেই। বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিরা ভূত-প্রেত বা এরকম অলৌকিক বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালালেও বিশ্বজুড়ে ভূতের অস্তিত্ব মেনে নিতে অনেকেই এখনো দ্বিধাহীন। সবচেয়ে বড় বিষয়, যে কোনো কারণেই হোক মানুষ ভূত নামক সেই অদৃশ্য অলৌকিক বস্তুটির প্রতি মানসিকভাবে দুর্বল। ভূত বলতে আসলে কিছু আছে কি? এ নামের কোনো সত্তা পৃথিবীতে বিরাজ করে কি-না এ নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কোনো শেষ নেই। এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নিয়েও রয়েছে ঢের বিতর্ক। শাস্ত্র মতে, ভূত বা প্রেতাত্দা যাই বলা হোক না কেন এসব আধ্যাত্দিক জিনিসের অস্তিত্ব পৃথিবীতে আছে। অধিকাংশ বিশ্বাস অনুসারে তারা মানুষের মতো না হয়েও মানুষের সঙ্গেই এই পৃথিবীতে বাস করে। একই বিশ্বাস অনুসারে তাদের জগৎ-বিশ্বাস-ধ্যান-ধারণা সবকিছুই মানুষের চেয়ে আলাদা।

পৃথিবীর নানা প্রান্তের উপকথা, গল্প এবং জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে ভূতের উল্লেখ। বলা হয়েছে, ভূত হল আত্দা বা স্পিরিট। একজন মানুষের মৃত্যুর পর তার অদৃশ্য উপস্থিতি। যদিও তার বিবরণ সর্বত্র এক নয়। কোথাও বায়বীয়, কোথাও জলের মতো, কোথাও ছায়া আবার কোথাও তারা পশু-পাখির অবয়বে বিরাজমান। পৃথিবীর সব ধর্মেই ভূতের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়েছে। ইংরেজিতে ঘোস্ট শব্দটির প্রাচীন ইংরেজির গাস্ট থেকে উদ্ধৃত। ল্যাটিনে 'স্পিরিটাস' শব্দটির অর্থ হলো শ্বাস বা জোরে বাতাস ত্যাগ করা। এমন নানা ব্যাখ্যা রয়েছে। বিভিন্ন ভাষায়, সেই আদিকাল থেকেই মানুষ সভ্য হওয়ার পরে, মোটামুটি যখন জ্ঞানের আলো একটু একটু করে প্রবেশ করেছে তাদের সমাজে, তখন থেকেই ভূত রাজত্ব শুরু করেছে। এর বিশেষ প্রমাণ রয়েছে আফ্রিকা ও বিশ্বের আদিম জাতির সমাজব্যবস্থায়ও আফ্রিকায় তো বটেই, ভারতের আদিবাসীদের মধ্যে ভূতের পূজো হয়ে থাকে। তারা মনে করে, তাদের পূর্বজরা এ রূপেই তাদের কাছে বেঁচে রয়েছে। হিন্দু ধর্মের 'গরুড় পুরাণ' পড়লে দেখা যায় সেখানে ভূতের অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা রযেছে। আমাদের হিন্দু শাস্ত্রে যে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়ে থাকে, তা যে মূর্তের আত্দার সঙ্গতির উদ্দেশ্যে সে কথা বিশদ করে বলার প্রয়োজন নেই। সেখানে বিভিন্ন মন্ত্রে 'ভূত' এবং 'প্রেত' শব্দ দুটির বহুবার উল্লেখ রয়েছে। পণ্ডিতেরা এই ভূত বা প্রেত বলতে বলেছেন, ভূত শব্দটি এসেছে ভূ তা বা অতীত শব্দ থেকে। প্রেত এসেছে প্রয়াত শব্দ থেকে।

একটা কথা তো মানতেই হবে যে ভূত থাক বা না থাক, তাকে নিয়ে মানুষের জিজ্ঞাসা ও কৌতূহলের অন্ত নেই। যেমনটা ঘটেছে সৃষ্টিকর্তা নিয়ে। যুক্তিবাদীরা স্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়েও কম কথা বলেন না। তবুও কিন্তু মানুষ স্রষ্টায় বিশ্বাস করে। আবার বিজ্ঞানের অনেক যুক্তি সংজ্ঞা অনুসারেও কিন্তু স্রষ্টার অস্তিত্বের ব্যাপারটি প্রমাণিত। সব মিলিয়ে দেখা যায় যে, মানুষের জীবনের সঙ্গে অলৌকিকত্বের একটা সম্পর্ক কোনো না কোনোভাবে থেকেই যাচ্ছে। আর বিজ্ঞান সব অলৌকিকত্ব বা বিষয়কে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে শতভাগ সাফল্য দেখাতে পারেনি। তাই অলৌকিক বা সুপার ন্যাচারাল একটা চিন্তা বা ধারণা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। আর সে কারণেই ভূত বিষয়ে মানুষের এমন বিশ্বাস। আর বিজ্ঞান যদি মানুষকে সফলভাবে এসব ব্যাখ্যা দিতে পারত তাহলে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বিশ্বের সিংহভাগ মানুষ এসবে বিশ্বাস রাখত না মোটেই।

ভূতের অস্তিত্বের প্রমাণ কাগজে-কলমে দেওয়া হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু বিশ্বসাহিত্যের দিকে তাকালে দেখা যায় এর অনেকটা জুড়েই রয়েছে ভূত। এক্ষেত্রে ভূত সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করল, নাকি সাহিত্য ভূতের অস্তিত্ব স্বীকার করল, এ প্রশ্ন বহু পুরনো। সেই প্রাচীন সাহিত্যে সংস্কৃতি গ্রিক, রোমান, ল্যাটিন, হিবরু, চিনা, আরবি ইত্যাদি। লেখা হয়েছে ভূতবিষয়ক হাজার হাজার রচনা। আবার অনেক রচনায় অত্যাবশ্যকভাবে এসেছে ভূত। পরবর্তীকালে, মধ্যযুগে বা তারও পরে, যখন সাহিত্য রোমান্টিসিজমের পুনরুত্থান ঘটল তখন [ষোড়শ শতকের গোড়া থেকে ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত], তাতেও নানাভাবে এই ভূত, প্রেত, অপদেবতা বা ডাইনিদের প্রসঙ্গ এসেছে। প্রায় পাঁচশ বছর আগে থেকেই এর সূচনা। শেকসপিয়রের বিভিন্ন নাটকে প্রেতাত্দার অস্তিত্ব কম-বেশি সবারই জানা। এর মধ্যে হ্যামলেট, ম্যাকবেথ, টেমপেস্ট মিউসামার নাইটস ড্রিম তো বহুল চর্চিত নাটক। এসব গল্পের কোথাও অশরীরী ভবিষ্যৎ বক্তা, কোথাও প্রতিশোধ নেওয়া ভূত, কোথাও ধোঁয়ার মতো এরিয়েল আবার কোথাও অন্যকোনো অবয়বে এসব ভূত বা অলৌকিক অশরীরী বিরাজমান রয়েছে।

আমাদের ভারতেও ভূতের ওপর রচিত সাহিত্যের অভাব নেই। সেই বিক্রমাদিত্য জমানার 'বিক্রম বেতাল'- এর কাহিনী থেকে শুরু করে হাল আমলের শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অসংখ্য ভূতের গল্প আজও পাঠকের প্রিয় সঙ্গী। ভারতের বিভিন্ন ভাষায় বহু রোমহর্ষক ভূতের গল্প আমাদের দেশের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করছে। এমনকি হলিউড-বলিউডের বহু বঙ্ অফিস সফল ছায়াছবি ভূতের গল্প নিয়ে রচিত। সব মিলিয়ে ভূতের অস্তিত্ব কিন্তু আমরাই কোনো না কোনোভাবে জানান দিই। 

বাংলাদেশ প্রতিদিন

0 comments: